নির্বাচন কমিশন (ইসি) সম্প্রতি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনীর একটি বিস্তৃত প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। প্রস্তাবিত এই পরিবর্তনগুলোতে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ নতুন বিধান, যার মধ্যে অন্যতম হলো পলাতক আসামিকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করা। এছাড়া অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান বাতিল, জামানতের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতা সম্প্রসারণও অন্তর্ভুক্ত।
![]() |
ইসি নতুন আরপিও সংশোধনী প্রস্তাব প্রকাশ
প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলোতে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার লক্ষ্য রয়েছে। তবে সমালোচকরা মনে করছেন, কিছু বিধান রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এবং অপব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে।
পলাতক আসামির প্রার্থীতা অযোগ্য হওয়ার বিধান
কবে একজন আসামিকে পলাতক ঘোষণা করে আদালত?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রসিকিউটোরিয়াল উপদেষ্টা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী প্রথম আলোকে জানান, কোনো মামলায় অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পরে আসামি আদালতে হাজির না হলে আদালত তাকে হাজির হওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার নির্দেশ দেয়। এরপরও হাজির না হলে সেই ব্যক্তি পলাতক আসামি হিসেবে গণ্য হন।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
প্রাথমিকভাবে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন পলাতক আসামিকে অযোগ্য করার প্রস্তাবটি নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছিল। তারা বলেছিল, এটি অসদুদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে। তবে সম্প্রতি ইসি এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় উভয় পক্ষ সন্তুষ্ট হয়েছে এবং মনে করেছে, এটি সংবিধান সম্মত ও যৌক্তিক।
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, "বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আইন পরিবর্তন ও সংশোধন হয়। সমসাময়িক বাস্তবতায় আমরা মনে করেছি, এটি রাখা উচিত। ভবিষ্যতে যদি অপব্যবহার হয়, তবে পুনর্বিবেচনা করা হবে।"
অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা সংক্রান্ত প্রস্তাব বাতিল
বর্তমান আইনে প্রার্থীরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে সরাসরি মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারে এবং অনলাইনের মাধ্যমে জমা দেওয়ার সুযোগও রয়েছে। ইসি প্রাথমিকভাবে অনলাইনে জমা দেওয়ার বিধান চালু করতে চেয়েছিল, তবে বর্তমানে সেই প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার বলেন, "এটি ভবিষ্যতে পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। বর্তমানে আমরা চাই প্রতিটি প্রার্থী সরাসরি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে আবেদন করবে।"
সশস্ত্র বাহিনী ও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব
প্রস্তাবে সশস্ত্র বাহিনীকে সংজ্ঞাভুক্ত করা হয়েছে। এতে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা ভোটকেন্দ্রে বিনা অনুমতিতে গ্রেপ্তারির ক্ষমতা পাবেন।
প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা সিদ্ধান্ত নেবেন, কে কতক্ষণ ভোটকক্ষে থাকবে, এবং অবজারভার ও সাংবাদিকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করবেন।
নির্বাচন কমিশনার বলেন, "ভোট প্রক্রিয়া স্বচ্ছ রাখতে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সাংবাদিক ও অবজারভারদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।"
নির্বাচন প্রার্থীর জামানত ও আর্থিক প্রতিবেদন
প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য জামানতের পরিমাণ ২০,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০,০০০ টাকা করা হয়েছে। প্রার্থীকে অবশ্যই সর্বশেষ বছরের আয়কর রিটার্ন এবং দেশে-বিদেশে থাকা সম্পদের হিসাব প্রদান করতে হবে।
প্রার্থী যদি হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেন, ইসি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারবে, এবং নির্বাচিত হলে সংসদ সদস্য পদ হারানোর বিধান থাকবে।
রাজনৈতিক দলের প্রার্থীতা ও নিয়মাবলী
- রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষিদ্ধ দল (যেমন: আওয়ামী লীগ) দলগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
- দলের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিযোগিতা করতে পারবেন।
- যারা লাভজনক প্রতিষ্ঠানে চাকরি বা শেয়ারধারক, তারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। লাভজনক প্রতিষ্ঠান বলতে বোঝানো হয়েছে, যেখানে সরকারের শেয়ার ৫০% এর বেশি।
ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিক ও অবজারভারদের ভূমিকা
প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা নির্ধারণ করবেন, সংবাদমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকরা ভোটকক্ষে কতক্ষণ থাকতে পারবেন। সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের জন্য আলাদা পরিচয়পত্র প্রদান করা হবে।
নির্বাচন কমিশনার বলেন, "যেখানে ভোটাররা উপস্থিত থাকবেন, সেই লাইনে প্রথম নজর থাকবে ভোটারের ওপর। সাংবাদিকরা ও অবজারভাররা সহায়ক হিসেবে থাকবেন।"
আইনি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
প্রস্তাবিত সংশোধনী আইনি ও রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
- পলাতক আসামি অযোগ্যতা: নির্বাচনে জোরপূর্বক প্রার্থীতা রোধ করবে।
- জামানত বৃদ্ধি ও আর্থিক প্রতিবেদন: নির্বাচনী স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।
- প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতা বৃদ্ধি: ভোটকেন্দ্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখবে।
সমালোচকেরা মনে করছেন, কিছু বিধান অপব্যবহারের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তবে ইসি আশ্বাস দিয়েছে, প্রয়োজন হলে রিভিউ ও পরিবর্তন করা হবে।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ ও তুলনা
অনেকে ভাবতে পারেন, আন্তর্জাতিকভাবে পলাতক আসামি বা বিচারাধীন প্রার্থী নির্বাচন করতে পারে কি না।
- যুক্তরাজ্যে, একজন প্রার্থী যদি আদালতে দণ্ডিত হন, তারা নির্বাচনে অংশ নিতে অযোগ্য।
- ভারতেও আদালতে সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না।
বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বিধান এই আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তবে এটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করবে। তথ্যসূত্র: BBC
উপসংহার
নির্বাচন কমিশনের নতুন আরপিও সংশোধনী প্রস্তাব সংবিধান এবং নির্বাচনী স্বচ্ছতা অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ। পলাতক আসামিকে অযোগ্য করা, জামানত ও আর্থিক প্রতিবেদন বৃদ্ধি এবং প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতা সম্প্রসারণ সবই নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ, নিরাপদ এবং ন্যায্য করে তুলবে। যদিও কিছু সমালোচনার ঝুঁকি আছে, ইসি জানিয়েছে, ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে এই বিধান পুনর্বিবেচনা করা হবে।
প্রশ্ন-উত্তর (FAQ)
১. পলাতক আসামি হলে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে কি?
না, প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী পলাতক অবস্থায় থাকা ব্যক্তিকে নির্বাচনে প্রার্থী হতে দেওয়া হবে না।
২. অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সুযোগ পুনর্বিবেচনা হবে কি?
ইসি জানিয়েছে, ভবিষ্যতে অনলাইনে জমা দেয়ার বিধান পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।
৩. জামানত ও নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব কী?
এটি নির্বাচনী স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করবে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীর আর্থিক সক্ষমতা নিশ্চিত করবে।
৪. রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য নতুন বিধান কেমন?
দলগতভাবে নিষিদ্ধ দলের অংশগ্রহণ বন্ধ, তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া সম্ভব। লাভজনক প্রতিষ্ঠানে থাকা ব্যক্তির প্রার্থীতা অযোগ্য।
৫. প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতা বাড়ানো কেন প্রয়োজন?
ভোটকেন্দ্রে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এবং অবজারভার ও সাংবাদিকদের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে।
0 মন্তব্যসমূহ